Logo

সাহিত্য সংস্কৃতি    >>   একজন আলোকবর্তিকা শিক্ষকের স্মরণে: মোঃ জহিরুল হক (১৯৩০–২০১৫) জাতীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক | আদর্শ মানুষ | স্নেহময় পিতা

একজন আলোকবর্তিকা শিক্ষকের স্মরণে: মোঃ জহিরুল হক (১৯৩০–২০১৫) জাতীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক | আদর্শ মানুষ | স্নেহময় পিতা

একজন আলোকবর্তিকা শিক্ষকের স্মরণে: মোঃ জহিরুল হক (১৯৩০–২০১৫) জাতীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক | আদর্শ মানুষ | স্নেহময় পিতা

ডা: আজিজ:
আজ আমার বাবা, মোঃ জহিরুল হক–এর মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করছি। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, আদর্শবান মানুষ, স্নেহময় পিতা ও প্রেরণাদায়ী পরামর্শদাতা—যাঁর জীবন ও কর্ম আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। শিক্ষার প্রতি তাঁর অবিচল নিষ্ঠা, মানবিকতা ও সবার প্রতি অগাধ ভালোবাসা কখনোই বিস্মৃত হওয়ার নয়। তিনি আমাদের হৃদয়ে চিরজীবী।

মোঃ জহিরুল হক (১৯৩০–২০১৫)

মোঃ জহিরুল হক জন্মগ্রহণ করেন নরসিংদি জেলার শিলমানদি ইউনিয়নের একটি ছোট গ্রাম বাঘহাটায়। তিনি ছিলেন তাঁর পিতামাতার একমাত্র সন্তান। তাঁর পিতা, এলাহী বক্স আফরাদ, ছিলেন তাঁর সময়ের একজন অসাধারণ মেধাবী ছাত্র। তিনি কলকাতা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ঢাকা গভর্নমেন্ট মুসলিম হাই স্কুল থেকে সম্মিলিত মেধাতালিকায় অষ্টম স্থান অধিকার করেন এবং পরবর্তীতে ঢাকা কলেজ থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেও চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন না বেছে নিয়ে তিনি নিজেকে শিক্ষাক্ষেত্রে নিবেদিত করেন—নরসিংদি অঞ্চলের শিক্ষার মানোন্নয়নের গভীর দায়বদ্ধতা থেকেই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আজীবন তিনি বিনামূল্যে মানুষের চিকিৎসা প্রদান ও শিক্ষার প্রসারে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নরসিংদি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে “আজীবন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক সম্মাননা” প্রদান করা হয়।
শৈশবেই আমার বাবা তাঁর ফুফুর গভীর স্নেহের টানে কিশোরগঞ্জে চলে যান। সেখানেই তিনি স্কুল ও কলেজের পড়াশোনা সম্পন্ন করেন এবং পরে গুরুদয়াল কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন মহকুমা স্কুল ইন্সপেক্টর হিসেবে। তবে এই পদে তিনি তৃপ্তি পাননি। কয়েক বছর পর দাদার অনুপ্রেরণায় তিনি সিলেট পাইলট হাই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এই সিদ্ধান্তই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়—কারণ এখানেই তিনি শিক্ষকতার প্রকৃত আনন্দ ও আত্মতৃপ্তি খুঁজে পান।
১৯৬৩ সালে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক খান মোহাম্মদ সালেক স্যার তাঁকে বিদ্যালয়ের সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্য দিয়ে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে সালেক স্যারের অনুরোধে তিনি জীববিজ্ঞানও পড়াতে সম্মত হন—যদিও এ বিষয়ে তাঁর কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগত পটভূমি ছিল না। বিদ্যালয়ের স্বার্থে তাঁর দায়বদ্ধতা ও নিষ্ঠাই এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল ছাড়াও তিনি গভর্নমেন্ট মুসলিম হাই স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং মোহাম্মদপুর গভর্নমেন্ট বয়েজ হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। টানা ৩২ বছরের সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে শিক্ষকতা ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯৪ সালে তিনি গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে “জাতীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক” পদকে ভূষিত করা হয়।
তাঁর ৩২ বছরের শিক্ষকতা জীবনে মোঃ জহিরুল হক বাংলাদেশের শিক্ষা অঙ্গনে এক অমলিন স্মৃতি রেখে গেছেন। অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে তিনি শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার আদর্শে গড়ে তুলেছেন। তাঁর নেতৃত্বে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক উভয় ক্ষেত্রেই দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সততা, মানবিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তিনি সহকর্মী, ছাত্র ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের গভীর শ্রদ্ধা অর্জন করেন।
পেশাগত জীবনের বাইরে তিনি ছিলেন এক আদর্শ পারিবারিক মানুষ—স্নেহময় পিতা, মমতাময় পরামর্শদাতা এবং নৈতিকতার জীবন্ত দৃষ্টান্ত। অবসরের পর তিনি তাঁর প্রিয় স্ত্রী, চার পুত্র, এক কন্যা এবং ক্রমবর্ধমান নাতি-নাতনিদের সঙ্গে এক শান্ত, স্নিগ্ধ জীবনযাপন করেন। অবসরেও তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন না—ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন এবং সারাজীবনের মতোই জ্ঞান ও চরিত্রের আদর্শকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাঁর ঘর ছিল হাসি, উষ্ণতা ও পারিবারিক বন্ধনের আলোয় উদ্ভাসিত।
২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনি শান্তিপূর্ণভাবে পরলোকগমন করেন। রেখে গেছেন এক স্নেহময়ী স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, নাতি-নাতনি এবং অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী—যারা আজও তাঁর শিক্ষা, মানবিকতা ও আদর্শকে বহন করে চলেছে।
আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তিনি ছিলেন এমন এক শিক্ষক, যিনি অসংখ্য জীবনে আলো জ্বেলে গেছেন। তাঁর রেখে যাওয়া মূল্যবোধ, ভালোবাসা ও শিক্ষার আদর্শ আজও আমাদের জীবনের প্রেরণা। শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় তিনি আমাদের সকলের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
কলামিস্ট ও ডা. আজিজ, লং আইল্যান্ড, নিউইয়র্ক ।